'মেয়েটি'। নাটকের নাম শুনে মনে হয়েছিল আর পাঁচটা চেনা ছকের মতই কোনো এক মেয়ের স্বপ্ন ভাঙ্গার গল্প যা দিয়ে দর্শকের মনটাকে ছোঁওয়া যায়। দেখার পরে উপলব্ধি হল শুধু স্বপ্ন ভাঙ্গাই নয়, ভাঙ্গার কারণটাও নগ্নভাবে সবার সামনে এসে পড়েছে। আর দর্শক হিসেবে আমি তখন পুরো সমাজটার সাথে সমাজব্যবস্থার সাথে দাঁড়িয়ে আছি আসামীর কাঠগড়ায়।
এ নাটকের পটভূমিকা চিলি। সদ্য স্বৈরতন্ত্রের অবসানের পর এসেছে গণতন্ত্র। জেরার্দো এস্কোবার গণতান্ত্রিক চিলির তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান, যাঁর কাজ স্বৈরাচারী যুগের নিখোঁজ ও নিপীড়িত মানুষদের প্রতি সুবিচার করা। যেদিন জেরার্দো চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয় সেদিন রাতে তাঁর গাড়ি রাস্তায় হঠাৎ অচল হয়ে যাওয়ায় এক ডাক্তার তাঁকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনেন এক ডাক্তার রবার্তো মিরান্দা। যার গলার আওয়াজ শুনে জেরার্দোর স্ত্রী পলিনা বুঝতে পারে এই সেই ডাক্তার যে ১৫ বছর আগে এক ডিটেনশন ক্যাম্পে তাকে ধর্ষণ করেছিল। ডাক্তারকে জেরার্দো সেরাতে তাঁর বাড়িতেই থেকে যেতে বলে। এরপরেই শুরু হয় পলিনার প্রতিশোধের পালা। নেশায় বেহুঁশ ডাক্তারকে সে একটা চেয়ারে হাত-পা-মুখ বেঁধে শুরু করে তার জেরা। জেরার্দো পলিনাকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করে এটা কোনো সমাধান নয়, কারণ সে সময়ে পলিনার চোখ বাঁধা ছিল। শুধু গলার আওয়াজ কোনো প্রমাণ নয়। পলিনা ডাক্তারের গাড়ি থেকে বের করে আনে শুবার্টের কম্পোজিশন 'ডেথ অ্যান্ড দ্য মেডেন' যা ডাক্তার বাজিয়েছিল পলিনাকে বারবার ধর্ষণের সময়। ক্রমশ পলিনার জেরা, ডাক্তারের সবকিছু অস্বীকার এবং জেরার্দোর মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে এগোতে থাকে নাটক। অবশেষে প্রাণভয়ে ভীত ডাক্তার স্বীকার করে সে পরপর চোদ্দবার পলিনাকে ধর্ষণ করেছিল। জেরার্দো খুন করতে যায় ডাক্তারকে। কিন্তু পলিনা ডাক্তারের বাঁধন খুলে দেয়।
স্বৈরতন্ত্র ও পুরুষতন্ত্রকে একই কাঠগড়ায় দাঁড় করায় 'মেয়েটি'। যে জেরার্দোর নাম না বলার জন্যে পলিনাকে ডিটেনশন ক্যাম্পের অকথ্য শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার সহ্য করতে হয়, ক্যাম্প থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে পলিনা ফিরে এসে দেখে সেই জেরার্দো অন্য এক মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে মা-কে আমরা বসাই বেশ উঁচু জায়গায় সেটা যে কতটা হাস্যকর কতটা ঠুনকো তা ধরা পড়ে যায় যখন পলিনা বলে "গালাগাল দেওয়ার সময় তো সবাই বলে 'son of a bitch', কই কেউ তো বলেন না 'son of a dog'!" পুরো নাটকে বিচারকের ভূমিকায় থাকা জেরার্দোর প্রতীতি জন্মায় ডাক্তারের স্বীকারোক্তির পরে। তার এতদিনের বিচার বলে আইন নিজের হাতে না নিতে কিন্তু তার পুরুষত্ব তাকে বলে ডাক্তারকে শাস্তি দেওয়া তাঁর কর্তব্য। পলিন ফিরে আসে প্রতিদিনের জীবনছন্দে। ক্লেদাক্ত অতীত সরিয়ে বর্তমানের স্বপ্ন দেখে। বাঁধাধরা ছকের ডাক্তার এবং জেরার্দো দু'জনেই হতবাক হয়ে যায় পলিনের এই আচরণে।
একইসঙ্গে এ নাটক প্রশ্ন তোলে আমাদের প্রতিশোধস্পৃহা নিয়ে। কতদিন আমরা 'চোখের বদলে চোখ' নীতি নিয়ে চলব! কিন্তু পলিনার ভাবনার স্বচ্ছতায় সমধানও আসে। একসময় কোনো এক পক্ষকে থামতেই হয়। কিন্তু থামার আগে পলিনা রেখে যায় আরেক প্রশ্ন। "কেন সবসময় আমাদেরই থামতে হবে? যারা অসহায়, দুর্বল তাদেরকেই কেন থামতে হবে?" নাটকের শেষে ছাড়া পেয়ে ডাক্তার যখন গুটিগুটি পায়ে মঞ্চ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, তার মুখে আমরা দেখতে পাই অপরাধবোধের জ্বালা। কিন্তু যদি অপরাধবোধের আগুনে পুড়ে অপরাধী মনটাই শুদ্ধ না হয়? তাহলে ক্ষমার তাৎপর্য কি?
এরিয়েল ডর্ফম্যানের 'ডেথ অ্যান্ড দ্য মেডেনে' নাটকের অনুবাদ করেছেন কাবেরী বসু। কিশোর সেনগুপ্তের নির্দেশনায় মাত্র তিনটি চরিত্র একটি সেট প্রায় দু'ঘন্টা (একটি দশ মিনিটের বিরতিসহ) আছন্ন করে রাখে দর্শককে। অসাধারণ দাপটে পলিনার চরিত্রে অভিনয় করেন বিন্দিয়া ঘোষ। তাঁর স্বরক্ষেপণের বৈচিত্র্য পলিনার চরিত্রে আলাদা মাত্রা এনে দেয়। ডাক্তার রবার্তোর চরিত্রটিকে গৌতম হালদার তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় পরিবেশন করেছেন। জেরার্দোর ভূমিকায় কিশোর সেনগুপ্তও চরিত্রানুগ। তবে কয়েকটি টেকনিক্যাল ত্রুটির মধ্যে উল্লেখ্য টেলিফোনের অপর প্রান্তের গলা রেকর্ড করে চালানোতে সময়ের একটু এদিক ওদিক হওয়ায় তাল কেটে যায়।
শুবার্টের কম্পোজিশন, মোকামের সংগীত, পর্দার পেছনে আলোর খেলা আর তার মাঝে পলিনার লাঞ্ছিত জীবনের প্রতিশোধ, ডাক্তারের ক্ষমাপ্রার্থনা, জেরার্দোর তথাকথিত পুরুষত্ব আর তার বিবেকের টানাপোড়েন - সব মিলে আমাদের নতুন করে ভাবায় আমাদের সমাজ নিয়ে, আমাদের রাজনীতি নিয়ে, পুরুষতন্ত্র নিয়ে। শেখায় কদর্যতা, বীভৎসতা, নিষ্ঠুরতা, প্রতিশোধস্পৃহার অনেক ঊর্ধ্বে জীবন।
একইসঙ্গে এ নাটক প্রশ্ন তোলে আমাদের প্রতিশোধস্পৃহা নিয়ে। কতদিন আমরা 'চোখের বদলে চোখ' নীতি নিয়ে চলব! কিন্তু পলিনার ভাবনার স্বচ্ছতায় সমধানও আসে। একসময় কোনো এক পক্ষকে থামতেই হয়। কিন্তু থামার আগে পলিনা রেখে যায় আরেক প্রশ্ন। "কেন সবসময় আমাদেরই থামতে হবে? যারা অসহায়, দুর্বল তাদেরকেই কেন থামতে হবে?" নাটকের শেষে ছাড়া পেয়ে ডাক্তার যখন গুটিগুটি পায়ে মঞ্চ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, তার মুখে আমরা দেখতে পাই অপরাধবোধের জ্বালা। কিন্তু যদি অপরাধবোধের আগুনে পুড়ে অপরাধী মনটাই শুদ্ধ না হয়? তাহলে ক্ষমার তাৎপর্য কি?
এরিয়েল ডর্ফম্যানের 'ডেথ অ্যান্ড দ্য মেডেনে' নাটকের অনুবাদ করেছেন কাবেরী বসু। কিশোর সেনগুপ্তের নির্দেশনায় মাত্র তিনটি চরিত্র একটি সেট প্রায় দু'ঘন্টা (একটি দশ মিনিটের বিরতিসহ) আছন্ন করে রাখে দর্শককে। অসাধারণ দাপটে পলিনার চরিত্রে অভিনয় করেন বিন্দিয়া ঘোষ। তাঁর স্বরক্ষেপণের বৈচিত্র্য পলিনার চরিত্রে আলাদা মাত্রা এনে দেয়। ডাক্তার রবার্তোর চরিত্রটিকে গৌতম হালদার তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় পরিবেশন করেছেন। জেরার্দোর ভূমিকায় কিশোর সেনগুপ্তও চরিত্রানুগ। তবে কয়েকটি টেকনিক্যাল ত্রুটির মধ্যে উল্লেখ্য টেলিফোনের অপর প্রান্তের গলা রেকর্ড করে চালানোতে সময়ের একটু এদিক ওদিক হওয়ায় তাল কেটে যায়।
শুবার্টের কম্পোজিশন, মোকামের সংগীত, পর্দার পেছনে আলোর খেলা আর তার মাঝে পলিনার লাঞ্ছিত জীবনের প্রতিশোধ, ডাক্তারের ক্ষমাপ্রার্থনা, জেরার্দোর তথাকথিত পুরুষত্ব আর তার বিবেকের টানাপোড়েন - সব মিলে আমাদের নতুন করে ভাবায় আমাদের সমাজ নিয়ে, আমাদের রাজনীতি নিয়ে, পুরুষতন্ত্র নিয়ে। শেখায় কদর্যতা, বীভৎসতা, নিষ্ঠুরতা, প্রতিশোধস্পৃহার অনেক ঊর্ধ্বে জীবন।