Sunday 14 December, 2008

অজ্ঞাতবাস : নাটকের মাঝে নাটক

যেসব মানুষেরা প্রতিনিয়তই আমাদের অজ্ঞাতে চলে যাচ্ছেন অজ্ঞাতবাসে, তাঁদের চাওয়া-পাওয়া নিয়েই নান্দীকারের নতুন নাটক 'অজ্ঞাতবাস' মানুষের জীবনে সমস্যাই বোধহয় সবচেয়ে বেশী সেই সমস্যার সমাধানও হয় নানারকমের নিঃসঙ্গতার এক নতুন সমাধানের সন্ধান দেয় 'অজ্ঞাতবাস' সমাধান? হয়তো নয়!

নববিবাহিত দম্পতি সৌমিক এবং পায়েল বাস করে একটি সুন্দর সাজানো গোছানো বাড়িতে আপাতদৃষ্টিতে তারা সুখী বিয়ের পরই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সৌমিকের বাবা বিয়ের যৌতুক হিসেবে পায়েলের হাতে তুলে দেন ঐ বাড়ীর চাবি সৌমিক নিজেও খুশি হয়, ভাবে পায়েলও খুশি হবে কিন্তু পায়েলের সবার সঙ্গে সংসার করার স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়, একা হয়ে যায় তার শ্বশুরের আশা ছিল "যাওয়া-আসা থাকবে, ফোনাফুনি থাকবে আর দূরত্বের জন্য থাকবে চোরাটান।" কিন্তু সময়ের ফাঁকে সেই চোরাটানও কে চুরি করে নেয় তাদের এই বয়ে চলা জীবনের মাঝে একদিন এসে পড়েন এক বৃদ্ধা প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা কিন্তু কোথায় বাড়ি, কোথায় যাচ্ছিলেন কিছুই মনে করতে পারেন না জল চাওয়ার অছিলায় ঢুকে পড়েন পায়েলের বাড়িতে ক্রমশ তাদের সংসারে সৌমিক অফিস থেকে ফিরে ডাক্তার-পুলিস করে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না হঠাৎ এসে পড়া এই আপদকে কিন্তু প্রাণোচ্ছল আকর্ষণীয়া এই বৃদ্ধার উত্তরের কাছে হেরে যায় পুলিস ডাক্তার সবাই প্রত্যেকটি চরিত্রের পরের পদক্ষেপ তাঁর জানা তাতেই বোঝা যায় তাঁর এইভাবে হারিয়ে যাওয়া এই প্রথম নয় একসময় সৌমিকও ধরা দেয় মায়ার বাঁধনে দু'টো মানুষও একা হয়ে যায় তাদের নিস্তরঙ্গ জীবনে এই বৃদ্ধা একদিনের জন্য হঠাৎ ব্যস্ততার হাওয়া বইয়ে দেন বহুদিন পরে হারমোনিয়াম বেরোয়, সৌমিক বলে ওঠে "শেষ কবে নিজের বাড়িতে এরকম চেঁটেপুটে খেয়েছি মনে পড়ে না!", রাত্রে ঘুমোতে যাওয়ার আগে দু'জনে মিলে ভাবতে বসে কিরকম হয় যদি পরেরদিন জানা যায় যে অনুরাধা দেবী ওদের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়া, যাকে ওরা ভুলে গিয়েছে! কেমন হয় যদি কাল থেকে উনি ওদের সঙ্গেই থাকবেন! 'মাসিমা'র গানের সঙ্গে তাদের মনও গেয়ে ওঠে "সকল দুয়ার আপনি খুলিল, / সকল প্রদীপ আপনি জ্বলিল, / সব বীণা বাজিল নব নব সুরে সুরে।।"

কিন্তু পরেরদিন সকালেই বৃদ্ধার সব কথা মনে পড়ে যায় সৌমিক তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসে কিন্তু বৃদ্ধা নেমে যান বাড়ির কিছু আগেই, যদি বাড়ির লোক তাঁর ভুলোমনের জন্য সৌমিকের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে সেই আশঙ্কায় সৌমিককে ফিরে যেতে বলেন কিন্তু সৌমিক পিছু নিয়ে বুঝতে পারে বৃদ্ধার জন্য কেউই অপেক্ষা করে ছিল না কেউই ওঁর জন্য সারারাত দুশ্চিন্তা করেনি, কেউ ছটফট করেনি উনি দিনের শেষে বাড়ি ফিরে আসেননি বলে তখনি তার কাছে ধরা পড়ে যায় একাকীত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যে, একটু গল্প করার লোকের খোঁজে, একদিনের জন্যে হলেও স্নেহ-ভালোবাসায় জড়িয়ে পড়ার জন্যে অনুরাধা ব্যানার্জীর একই নাটকে বারবার অভিনয়ের খেলা নিজেই নিজের স্মৃতি ভুলে অজ্ঞাতবাসে যাওয়ার নাটক নাটক পূর্ণতা পায় যখন বৃদ্ধা পায়েল অনুরাধা দেবীর দেখানো পথে বেরিয়ে পড়ে অজ্ঞাতবাসে

সুমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশনা ত্রুটিহীন নাটকে নতুন মাত্রা দান করে প্রোজেক্টরের ব্যবহার নাটকের আবহ পরিবেশনায় প্রোজেক্টরের ব্যবহার প্রচলিত কিন্তু এখানে গল্প বলাতেই আনা হয়েছে চলচ্চিত্র সৌমিকের অনুরাধা দেবীকে পৌঁছে দেওয়া এবং পিছু নেওয়া পুরোটাই প্রোজেক্টরের সাহায্যে উপস্থাপিত ত্রিমাত্রিক থেকে দ্বিমাত্রিকে এই হঠাৎ পরিবর্তন খাপছাড়া লাগে না, বরং মুগ্ধ করে তবে প্রথম দৃশ্যে পরিচারিকার স্থূল অঙ্গভঙ্গী এবং হালকা চালের অভিনয় নাটকের পরিপ্রেক্ষিতে অপ্রয়োজনীয় মনে হয়

সোহিনী হালদার, স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত এবং রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তকে দেখে কখনোই মনে হয় না তারা অভিনয় করছেন অনায়াস ভঙ্গীতে আমাদের ঘরোয়া দৃশ্যের দর্শক করে নেন নববিবাহিতা বধূ এবং বৃদ্ধা - একটি চরিত্র থেকে আরেকটিতে অনায়াসে বিচরণ করে যান সোহিনী হালদার অনুরাধা দেবীর চরিত্রে স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত আলাদা মাত্রা যোগ করেন যখন হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান ধরেন "মন্দিরে মম কে আসিলে হে! / সকল গগন অমৃতমগন, / দিশি দিশি গেল মিশি অমানিশি দূরে দূরে।।" স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় মনোরোগে স্বল্পজ্ঞানী এক সাধারণ চিকিৎসককে স্বল্প সময়ে নিখুঁতভাবে মঞ্চে উপস্থাপন করেছেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত শুধু নির্দেশক সুমন্ত গঙ্গোপাধ্যায় প্রথমার্ধে যখন বিরক্তি প্রকাশ করেন বৃদ্ধার প্রতি তখন তা অতিনাটকীয়তার পর্যায়ে চলে যায় কিন্তু সৌমিক যখন পায়েলকে বৃদ্ধার বাড়ির মিথ্যা বিবরণ দিতে দিতে বাচ্চার মত কেঁদে ফেলে দর্শকের মনো উথাল-পাথাল করে ওঠে

অনুরাধা দেবীর নিজের জীবনকে এইরকমভাবে নিজের পরিচালিত নাটক করে নেওয়া দেখতে দেখতে মনে পড়ে যায় সুচিত্রা ভট্টাচার্য্যের শান্তি পারাবারের চারু ঠাম্মার কথা যার নাতি বৃদ্ধাবাসে তার সঙ্গে দেখা করতে আসত তাঁর তোশকের নীচে রাখা কয়েনের লোভে ঠাকুমা অন্যমনস্ক হলেই ঝটপট সেগুলো পকেটে পোরে চারু ঠাম্মা দেখেও দেখেন না নাতি আসার আগে নিজেই সাজিয়ে রাখেন কয়েগুলো নাতির আসা বজায় রাখতে রুদ্রপ্রসাদের কথায় এই নাটকের জন্য কাউকেই দোষী করা যায় না "আমরা ভয় পাই ভালোকে স্বীকার করতে। কারণ ভালো জিনিস বড় কাঁদায়। কিন্তু মানুষ যখন ভালোকে স্বীকার করে নিতে পারে তখন সে কেঁদে কেঁদে শুদ্ধ হয়।" মাঝে শুদ্ধ হলে বোধহয় মনটাও একটু পরিষ্কার হয় তখন বোধহয় মানুষের আয়তনের জায়গাটাকেই স্পেস বলে ভুল করি না, মনেও জায়গা করে দিতে শিখি

1 জনের কথা:

phenomenal woman said...

Ektai katha bolbo. Dhonyobaad! Ichchha thaka sotweo amar natok ekebarei dekha hoye othe na. Kintu eta pore mone holo OGYATOBAS sposhto dekhte pachchhi. Bujhte parchhi. Drishti dhaar debar jonne abar bolchhi, dhonyobaad.

Chaliye ja. Lekhar dhoron ebong somalochona--- 2toi khub bhalo laglo. Erokom jano aro onek pai.

Post a Comment